পাঠক
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে জানার প্রথম উৎস হলো কোরআন। মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও আদর্শ মানবতার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি সবসময় মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন এবং মানুষকে জীবনের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা আজকের বিশ্বেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বৈষম্যের বিভিন্ন দিক, যেমন- সামাজিক, অর্থনৈতিক, জাতিগত, ধর্মীয় এবং লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য, সবগুলোর বিরুদ্ধে মুহাম্মদ (সা.) এর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট এবং কঠোর। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হল, মানবজাতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এবং প্রত্যেক মানুষ এক আল্লাহর সামনে সমান। এই মূলনীতি থেকেই মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনে বৈষম্য দূর করার শিক্ষা দিয়েছেন এবং তিনি এমন একটি সমাজের ভিত্তি গড়ে তুলেছেন যেখানে মানুষ পারস্পরিক সম্মান, ন্যায়বিচার এবং ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সহাবস্থান করতে পারে।
বৈষম্যহীনতার ভিত্তি: মহানবী হয়রত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এই সাম্যের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বারবার মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের জন্ম, জাতি, ভাষা বা অর্থনৈতিক অবস্থান তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করতে পারে না। বরং, আল্লাহর দৃষ্টিতে যারা পবিত্র জীবন যাপন করেন এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেন, তারাই প্রকৃত শ্রেষ্ঠ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার।...” (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩)। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, জাতিগত পার্থক্য শুধুমাত্র মানুষের মধ্যে পরিচয়ের জন্য এবং এর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা উচিত নয়। মুহাম্মদ (সা.) এই নির্দেশনা অনুসরণ করে সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা বলেছেন।
ইসলামে সাম্যের অন্যতম উদাহরণ হল হজ। হজের সময় লক্ষ লক্ষ মুসলিম একই পোশাকে, একই স্থানে, একই নিয়মে আল্লাহর ইবাদত করে। সেখানে ধনী-গরীব, কালো-সাদা, আরব-অনারবের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। সবাই একসঙ্গে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য চেষ্টা করে। এটি মানবজাতির মধ্যে সাম্যের এক অনন্য প্রতীক।
আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ: মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করেছেন। মক্কার অভিজাত শ্রেণী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশাল পার্থক্য ছিল, ধনী শ্রেণী গরীবদের উপর অত্যাচার চালাতো। গরীব মানুষেরা তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে না পারার কারণে আরও অসহায় হয়ে পড়তো।
ধনী-গরিবের মধ্যে এই বৈষম্য দূর করতে মহানবী (সা.) এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা ধনীদের থেকে সম্পদের একটি অংশ গরীবদের মাঝে বিতরণ করা বাধ্যতামূলক করে তোলে। যাকাত ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম, যা মুসলমানদের উপর ফরয করা হয়েছে। এটি হলো ধনীদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা। এটি কোনো দয়া নয়, বরং গরীবদের অধিকার। যাকাতের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হয় এবং ধনী-গরীবের মধ্যে পার্থক্য কমে যায়। এছাড়াও, মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্ন সময়ে ধনীদেরকে আরও বেশি দান করতে উৎসাহিত করেছেন, যাতে সমাজের দরিদ্রমানুষরা তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেতে পারে।
মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সহায়তায় থেমে থাকেননি, তিনি সামাজিক এবং নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে এমনভাবে গড়ে তুলছেন, যাতে কেউ কারো প্রতি অত্যাচার বা অবিচার করতে না পারে। তিনি মানুষকে ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা এবং দয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। ফলে মুহাম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশায় মক্কা ও মদিনার সমাজে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য অনেকাংশে কমে যায়।
দাসপ্রথা ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম: মুহাম্মদ (সা.) দাসপ্রথার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ (সা.) এর আগমনের সময় আরব সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল এবং দাসদেরকে নীচু ও অবহেলিত হিসেবে গণ্য করা হতো। তিনি দাসদের প্রতি ভালো আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ধীরে ধীরে দাসপ্রথার অবসান ঘটানোর জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি দাসদের মুক্তির উপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বিভিন্ন উপায়ে দাসদের মুক্তি দিতে উৎসাহিত করেছেন। যেমন- ইসলাম ধর্মে যদি কেউ কোনো ভুল করে, তবে তার কাফফারা হিসেবে একটি দাসকে মুক্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়াও, তিনি সাহাবীদের দাসমুক্তির জন্য প্রচার করেছেন এবং নিজেও অসংখ্য দাসকে মুক্তি দিয়েছেন। মুহাম্মদ (সা.) জাতিগত বৈষম্যেরও কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “কোনো আরব অনারবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না এবং কোনো অনারবও আরবের উপর শ্রেষ্ঠত্বদাবি করতে পারে না, কোনো সাদা কালোর উপর শ্রেষ্ঠ নয় এবং কোনো কালোও সাদার উপর শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্ব শুধুমাত্র তাকওয়ায় (ধর্মভীরুতা)।” এর মাধ্যমে তিনি মানুষের মধ্যে জাতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বার্তা প্রদান করেছেন।
একটি সুপরিচিত উদাহরণ হল বেলাল (রা.), যিনি ছিলেন একজন আফ্রিকান দাস। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গী হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বেলাল (রা.) এর মতো একজন দাসকে সম্মানের এই স্থানে অধিষ্ঠিত করা ইসলামের বৈষম্যহীনতার অন্যতম প্রমাণ।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: মুহাম্মদ (সা.) এর আগমনের পূর্বে আরব সমাজে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। তারা ছিল পুরুষদের অধীন এবং তাদের কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না। কন্যা শিশুদের জীবিত কবর দেওয়া হতো এবং নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মহানবী (সা.) এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। মুহাম্মদ (সা.) নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার এবং মর্যাদা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “নারীরা পুরুষদের সহোদরা।” অর্থাৎ, সমাজে নারী এবং পুরুষের মর্যাদা সমান এবং তাদের সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্বও সমান। তিনি নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার এবং স্বাধীনতার অধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করেন। নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম উদাহরণ হল তাঁর স্ত্রীদের সাথে তাঁর আচরণ। তিনি কখনোই তাঁর স্ত্রীদের উপর কোনো অত্যাচার করেননি এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন থেকে আমরা দেখতে পাই যে তিনি সবসময় নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করেছেন।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সংখ্যালঘুদের অধিকার: মুহাম্মদ (সা.) এর সময়ে আরব উপদ্বীপে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করতো। তিনি কখনোই অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেননি, বরং তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা শান্তি পূর্ণভাবে সহাবস্থান করতো। মদিনা সনদ ছিল এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি, যেখানে মুসলিম এবং অমুসলিমরা পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব ভাগাভাগি করে চলতো। মদিনা সনদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মদিনার সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ একটি সাম্যবাদী সমাজের অংশীদার এবং তারা একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল। মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (সা.) মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে শান্তিও সহাবস্থানের নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মদিনায় ইহুদি, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করতে পারতেন এবং তাদের অধিকার রক্ষিত ছিল। এটি একটি অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল, কারণ সে সময় বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে সহাবস্থান খুবই কঠিন ছিল। মুহাম্মদ (সা.) এর এই উদাহরণ বর্তমান বিশ্বেও প্রাসঙ্গিক, যেখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।মুহাম্মদ (সা.) সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মদিনায় বসবাসরত ইহুদিদের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী, তারা মুসলিমদের মতই সমান অধিকার ভোগ করতে পারতো এবং তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) দেখিয়েছিলেন যে ইসলাম একটি সহিষ্ণু ধর্ম, যা অন্য ধর্মের মানুষদেরও সম্মান প্রদান করে।
সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব: মহানবী মুহাম্মদ (সা.) সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের যে নীতি প্রচার করেছেন তা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি। তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মুহাজির (মক্কা থেকে আগত শরণার্থী) এবং আনসারদের (মদিনার স্থানীয় বাসিন্দা) মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করা। মুহাজিররা যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন তাদের জীবনে স্থিতিশীলতা আনার জন্য মুহাম্মদ (সা.) আনসারদের সাথে তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এটি ছিল এক অনন্য পদক্ষেপ, কারণ এতে দুই ভিন্ন শ্রেণীর মানুষরা পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং পরস্পরকে সাহায্য করতে শুরু করেন। এই ভ্রাতৃত্বের নীতির মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সমতা এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে মানুষ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সমান মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করবে। ইসলামের প্রথম যুগে এই ভ্রাতৃত্বের চেতনা এতটাই গভীর ছিল যে, ধনী-গরীব, আরব-অনারব, কালো-সাদা সকলেই একসঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে।
অধিকার ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা: মুহাম্মদ (সা.) সব মানুষের অধিকার এবং ন্যায়বিচারের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "জুলুম থেকে দূরে থাকো, কারণ জুলুম অন্ধকারের কারণ।" তাঁর এই শিক্ষা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
উপসংহার: মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও আদর্শ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর শিক্ষা এবং পদক্ষেপগুলো আজকের সমাজেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে এখনও সামাজিক, অর্থনৈতিক, জাতিগত, ধর্মীয় এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিদ্যমান। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা একটি এমন সমাজ গড়তে পারি, যেখানে সকল মানুষ সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত হবে এবং সকল বৈষম্যের অবসান ঘটবে। মুহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মানবতার প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, এবং ন্যায়বিচারের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে তিনি যে নীতি ও আদর্শ প্রচার করেছেন, তা অনুসরণ করলে বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও শিক্ষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েআমাদের সমাজকে বৈষম্যহীন এবং সমানাধিকার ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
- আসাদুজ্জামান রনি; শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা।
মতামত